প্রমথ চৌধুরী : আত্মকথার অংশ
ভাষা আমরা একমাত্র লোকের মুখে শিখিনে, বই পড়েই শিখি। কৃষ্ণনগরে বাস-কালে আমি কী-কী বই পড়েছিলুম, তা বলছি। আমি ছাত্রবৃত্তি স্কুলে কাশীদাসের মহাভারতের কতক অংশ, আর হয়তো বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সীতার বনবাস পড়ি। কৃষ্ণচন্দ্রের বাঙ্গলার ইতিহাস ও তারিণীচরণের ভারতবর্ষের ইতিহাস— এই দুখানি বই আমায় স্বদেশের ইতিহাসের জ্ঞান দেয়। সেকালে আমার মনে হত, বই দুখানি ভালো ও সুখপাঠ্য। আমাদের বাড়িতে বাংলা বইও খানকতক ছিল। বঙ্গদর্শন বাঁধানো ছিল। আর সেই বাঁধানো বঙ্গদর্শন থেকে আমি বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ, আর বোধ হয় কপালকুণ্ডলা পড়ি। দীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনী, লীলাবতী, সুরধুনী কাব্য আর নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধও পড়ি। নীলদর্পণ আমি পড়িনি, কিন্তু তার অভিনয় দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠি। রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান আমাদের খুব প্রিয় কাব্য ছিল। আর এ ছাড়া শিশির ঘোষের নওশ’ রুপেয়া।
বাবা বাংলা বই পড়তেন না, কেননা তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি দেদার বই পড়তেন, কিন্তু সে সবই ইংরেজি বই। তবে এ সব বই এল কোত্থেকে— বাবা যখন যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখন দীনবন্ধু মিত্র সে শহরে পোস্ট আফিসে কোন বড় চাকরি করতেন, নবীন সেনও ছোকরা ডেপুটি ছিলেন, আর আমার বিশ্বাস, বঙ্কিমের ভাই সঞ্জীবও ছিলেন ডেপুটি; আর শিশির ঘোষ তো যশোরের লোক।
সে যা-ই হোক— অল্পবয়সেই আমি কালী সিংহের মহাভারত পড়েছি, আর পড়েছি হরিদাসের গুপ্তকথা। এ বই অবশ্য বালকের পাঠ্য নয়, কিন্তু তার ভাষা সাধুভাষা নয়, আর অতিশয় চটকদার। সে বইয়ের প্রথম পাতা পড়ে দেখবেন— লেখা কী চমৎকার। অবশ্য আরব্য উপন্যাস বাংলায় পড়েছি আর পারস্য উপন্যাস, রবিনসন ক্রুশো ও রাসেলাস্। হেমচন্দ্রের কবিতাবলীর একটি কবিতা ‘ভারত সঙ্গীত’ আমাদের সেকালে মুখস্থ ছিল। সেকালে বাঙালির মনে পেট্রিয়টিজমের জোয়ার এসেছিল— আর আমরা ছোট ছেলেরা সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলুম।
আমাদের বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা ছিল। বাবার পড়ার ঝোঁক বোধ হয় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করি।
আমার বড়দাদা ইংরেজি ভাষা খুব ভালো জানতেন; আর আমার সেজ-দাদা কুমুদনাথ অল্পবয়েস থেকেই ছিলেন শিকারি। তিনি শিকারের বই পেলেই পড়তেন। শেষবয়সে তিনি শিকার করতে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। তিনিই আমাকে ইংরেজি নভেল পড়তে শেখান, এ কথা পূর্বে বলেছি।
আমাদের ইংরেজি সাহিত্যচর্চার সুযোগ ছিল। বাবার একটি ইংরেজি বইয়ের প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। মা-র মুখে শুনেছি, বাবা হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করে ফেরবার সময়ে এক দিনে এই লাইব্রেরি কেনেন। এ লাইব্রেরিতে ছিল অনেক ইতিহাসের বই ও প্রতি ঐতিহাসিকের সমগ্র বই। কারও বই সাত-আট ভল্যুমের কম নয়। আর ছিল স্কটের সমস্ত বই। দশ-বারো ভল্যুম শেক্সপিয়ারের, মিলটনের সমস্ত কাব্য, বায়রনেরও তা-ই। বলা বাহুল্য এ সব বই আমরা স্পর্শও করিনি। মধ্যে-মধ্যে স্কটের দু-একটি নভেল পড়েছি। এই লাইব্রেরির প্রসাদে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি বহু ইংরেজি বইয়ের নাম জানতাম। এর ফলে দাদার, সেজদার, আমার ও আমার ছোট ভাই অমিয়র বই কেনা বাতিক হয়।
পরে আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি লাইব্রেরি সংগ্রহ করি। সব চাইতে বড় লাইব্রেরি ছিল দাদার, তারপর সেজদার ও অমিয়র। বাবার লাইব্রেরি ও দাদার লাইব্রেরি এখন কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার ফরাসি লাইব্রেরিও সেখানে, এবং আমার ইংরেজি বই শান্তিনিকেতনে। আর শ-পাঁচেক বই আমার কাছে আছে।
বই কিনলেই যে পণ্ডিত হয়, তা অবশ্য নয়। তবুও এ সব কথা বলছি এই জন্য যে, লাইব্রেরি করার শখ এখন আর লোকের নেই। তার একটি কারণ, লাইব্রেরি থাকলে পুরনো কাগজের দামে বিক্রি হয়।
কলকাতা শহরে দেখেছি কোন-কোন বাড়িতে বড় লাইব্রেরি ছিল; এখন নেই।
আমি জানি সুবোধ মল্লিকের কাকা হেমন্ত মল্লিকের বাড়িতে একটি নাতি-হ্রস্ব লাইব্রেরি ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেদার বই কিনতেন, কিন্তু লাইব্রেরি গড়েননি। গগনেন্দ্র ঠাকুরের বাড়িতে একটি প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল। এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের একটি চমৎকার লাইব্রেরি ছিল। তাঁর সংগৃহীত ফরাসি বই আমি কিনি। কিন্তু তাঁর ইংরেজি বইয়ের কী হল জানিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয়েরও প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ছিল।
এ সব কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা কৈশোরে লাইব্রেরির আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছি। এখন লাইব্রেরি হয়েছে সকলের জন্য, ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়।
মনফকিরা প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরী রচিত ‘আত্মকথা’র অংশবিশেষ