ডারউইনের প্রশ্ন ও অন্যান্য : এদুয়ার্দো গালেয়ানো
ডারউইনের সমুদ্রযাত্রা
তরুণ চার্লস ডারউইন জানতেন না তাঁর জীবন নিয়ে কী করবেন। তাঁর বাবা তাঁকে উৎসাহিত করেন :
“তুমি নিজের আর তোমার পরিবারের সকলের কাছে অসম্মানের কারণ হবে।”
১৮৩১-এর শেষে, তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকা, গালাপাগোস ও দূরদূরান্তের সব জায়গায় ভ্রমণের পর তিনি লন্ডনে ফেরেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন তিনটে বিশাল কচ্ছপ, যার একটা ২০০৭-এ অস্ট্রেলিয়ার এক চিড়িয়াখানায় মারা যায়।
অন্য মানুষ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। এমনকী তার বাবাও তা লক্ষ করেন :
“ওর মাথার আকৃতিটা যেন বদলে গেছে!”
কচ্ছপের চেয়ে বেশি কিছু নিয়ে ফিরেছিলেন তিনি। নিয়ে এসেছিলেন প্রশ্ন। প্রশ্নে ভরে উঠেছিল তাঁর মাথা।
ডারউইনের প্রশ্ন
পশমি ম্যামথের গায়ে মোটা ত্বক থাকে কেন? ম্যামথ কি কোন ভাবে হাতি হতে পারে যে বরফ যুগ শুরুর সময়ে এই ভাবে উষ্ণ থাকার উপায় খুঁজে পায়?
জিরাফের ঘাড় এত লম্বা কেন? এমন কি হতে পারে যে সময়ের পথ ধরে গাছের মগডালের ফল পাড়ার জন্য তা ক্রমেই লম্বা হয়ে উঠেছে?
বরফের দেশে খরগোশ কি সব সময়ে শাদাই ছিল, নাকি শিয়ালকে বোকা বানানোর জন্য তারা ক্রমে শাদা হয়ে উঠেছে?
ফিঞ্চের চঞ্চু বাসস্থান সাপেক্ষে এমন আলাদা হয় কেন? এমন কি হতে পারে যে দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ধীরে-ধীরে পরিবেশের সঙ্গে তা খাপ খাইয়ে নিয়েছে, যাতে তারা ফলের আবরণ ভাঙতে, শূককীট ধরতে আর ফুলের রস পান করতে পারে?
অর্কিডের অবিশ্বাস্য দীর্ঘ গর্ভকেশর কি এমন ইঙ্গিত দেয় যে কাছাকাছি তা হলে এমন প্রজাপতি রয়েছে যাদের জিহ্বা তাদের জন্য অপেক্ষমান গর্ভকেশরের মতোই দীর্ঘ?
কোন সন্দেহ নেই যে এইরকম হাজার-একটা প্রশ্ন সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বহু সংশয় ও দ্বন্দ্ব পেরিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব এবং পৃথিবীতে জীবের বিবর্তন নিয়ে তাঁর বিস্ফোরক বইয়ে লিখিত পৃষ্ঠায় পরিণত হয়।
ঈশ্বরবিরোধী ধারণা, অবমাননার অসহনীয় পাঠ : ডারউইন প্রতিভাত করেন যে ঈশ্বর মোটেই সাত দিনে পৃথিবী সৃষ্টি
করেননি, তাঁর অবয়ব ও প্রতিরূপেও আমাদের তৈরি করেননি।
এরকম ভয়াবহ সংবাদ খুব ভালো ভাবে গৃহীত হয়নি। কে এই লোকটাকে এ কথা ভাবার সাহস দিয়েছে যে বাইবেলের
সে সংশোধন করতে পারে?
অক্সফোর্ডের বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ডারউইনের পাঠকদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন :
“বনমানুষ থেকে যে তোমরা এসেছ, সে কি ঠাকুরদার দিক থেকে, নাকি ঠাকুমার?”
আমি তোমাকে বিশ্ব দেখাব
ডারউইন জেমস কোলম্যানের ভ্রমণ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে উদ্ধৃত করতে পছন্দ করতেন।
ভারত মহাসাগরের যাবতীয় জীবিত প্রাণী,
জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের ঊর্ধ্বাকাশ,
আরব্য রজনীর দীপ্তি,
জাঞ্জিবারের উত্তাপের বর্ণ,
সিংহলের বাতাস, যাতে ভাসে দারুচিনির সুবাস,
এডিনবার্গে শীতেকালের ছায়া,
আর রুশ কারাগারের ধূসরতার
এত ভালো বর্ণনা আর কেউ দেননি।
হাতে শাদা বেতের ছড়ি নিয়ে, কোলম্যান গোটা বিশ্বের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন।
এই ভূপর্যটক, যিনি আমাদের দেখতে সাহায্য করেছেন, ছিলেন অন্ধ।
“আমি আমার পা দিয়ে দেখি,” বলেছিলেন তিনি।
একমাত্র মানুষ
ডারউইন আমাদের বলেছিলেন, আমরা বনমানুষের আত্মীয়, দেবদূতদের নই। পরে, আমরা জানলাম যে আমরা এসেছি আফ্রিকার জঙ্গল থেকে, মোটেই কোন সারস আমাদের প্যারিস থেকে বয়ে আনেনি। এবং খুব বেশিদিন আগে নয় যখন আমরা আবিষ্কার করি যে আমাদের সব জিন বা বংশাণু অনেকটাই ইঁদুরের সমগোত্রীয়।
এখন আর আমরা বলতে পারি না যে আমরা ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ-তম সৃষ্টি, নাকি শয়তানের বাজে কৌতুক। আমরা পুঁচকে মানুষ :
সব কিছু ধ্বংস করি,
নিজেরাই নিজেদের শিকার করি,
পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা বানিয়েছি আমরা, আর নিউট্রন বোমা, যা সমস্ত বোমার মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর, কারণ তা মানুষকে বাষ্পে পরিণত করে, কিন্তু অন্যান্য বস্তু অক্ষত থাকে,
আমরাই একমাত্র প্রাণী যারা যন্ত্র তৈরি করেছি,
আর আমরাই একমাত্র যারা উদ্ভাবিত যন্ত্রের দাস হয়ে বাঁচি,
আমরাই একমাত্র যারা নিজেদেরই ঘরবাড়ি গ্রাস করি,
আমরাই একমাত্র যারা যে-জল আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করে, যে-ভূমি আমাদের খাদ্যের যোগান দেয়, তা বিষিয়ে দিই,
আমরাই একমাত্র যারা নিজেদের ভাড়া দিতে বা বিক্রি করতে পারি, আমাদেরই পাশের মানুষটিকে ভাড়া দিতে বা বিক্রি করে দিতে পারি,
আমরাই একমাত্র যারা স্রেফ মজা করার জন্য হত্যা করি,
নির্যাতন করি,
ধর্ষণ করি।
এবং আমরাই একমাত্র যারা হাসি,
দিবাস্বপ্ন দেখি,
যারা পোকার লালা থেকে রেশম তৈরি করি,
আমরাই একমাত্র যারা আবর্জনায় সৌন্দর্য খুঁজে পাই,
যারা রংধনু ছাড়িয়েও রং আবিষ্কার করি,
আমরাই একমাত্র যারা নতুন সংগীতে সারা বিশ্বের কণ্ঠস্বর সাজিয়ে তুলি,
এবং সৃষ্টি করি শব্দ যাতে বাস্তবতা বা স্মৃতি কখনও না
মৌন হয়।
এদুয়ার্দো গালেয়ানো : আ য় না আমাদের প্রায় সব্বার গপ্প
ভাষান্তর : নুসরাত জাহান সন্দীপন ভট্টাচার্য