নিজের কথা : জন লেনন
আ মা র প্র তি ভা
সফল যে-কেউই হতে পারে। বার বার নিজেকে এ কথা যদি বলো, তো হবে। অন্য কারও চেয়ে আমরা কিছু তালেবর ছিলাম না। আসলে আমরা সবাই সমান। ভেতরে সবাই এক।
আকাঙ্ক্ষাটা থাকা দরকার, আর পরিস্থিতি। কিন্তু এর সঙ্গে প্রতিভা বা শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। আদিম শিল্পীদের কে আর আঁকতে শিখিয়েছিল? তারা নিজেরাই নিজেদের বলেছিল, আমরা পারি। তা-ই পেরেছিল।
প্রতিভা কী? আমি জানি না। প্রতিভা নিয়ে লোকে জন্মায়, নাকি পরে তা টের পাওয়া যায়? আদত প্রতিভা হল এই বিশ্বাস যে, আমি পারি।
পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত আমি অন্য কারও চেয়ে কিছু আলাদা ছিলাম না। তার পর আমি ঠিক করি যে দু-একটা ছোটখাটো গান লিখব। তো, লিখলাম। তাতেও আমি কিছু আলাদা হয়ে গেলাম না।
আমার সত্যি কোন প্রতিভা নেই। প্রতিভার এই মিথ-টা সত্যি কারও ফুটো করে দেওয়া দরকার।
রাজনীতিকদের যেমন কোন প্রতিভা নেই, ওরা স্রেফ দুর্বৃত্ত।
হয়তো আমার গুরু কোন দিন আমাকে বলবে যে আমার আসল প্রতিভা কোথায়, ঠিক কোন্ কাজটা আমার করা দরকার।
আ মা র দা য়ি ত্ব
আইডল হিশেবে কোন রকম দায়িত্ব আমি কোন দিন বোধ করিনি। আমার কাছ থেকে এ সব আশা করা বোকামি। লোকে যেটা করেছে সেটা হল, ওদের দায়িত্ব স্রেফ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।
পল (ম্যাকার্টনি) যেমন একবার ওর এলএসডি নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছিল যে ওরা যদি দায়দায়িত্ব নিয়ে এতই চিন্তিত, তা হলে কথাটা না-ছাপলেই পারে। তা হলে আর লোকে তার কুপ্রভাবে পড়ে না।
আমরা যত দূর সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছি। দায়িত্ব বলতে এটুকুই। আমাদের সামাজিক মুখটা নিয়ে আমরা ভেবেছি, কিন্তু সে-ও তো স্বাভাবিক।
একই কথা সর্বত্র জিগ্যেস করা হলে বিরক্তি চেপে রাখা মুশকিল। এত লোকের সঙ্গে, প্রভাবশালী এত লোকের বউদের সঙ্গে সামাজিকতা বজায় রাখা ভয়াবহ। যত সব রুচিহীন লোক, তারাই কীনা রুচির ব্যাপারটা ঠিক করছে! যাদের নিজেদেরই কোন মান নেই, তারাই মান ঠিক করে দিচ্ছে।
প্রথম থেকেই এ সব ঘেন্না করে এসেছি। লোকে বলে, এ সবের মধ্যে দিয়ে নাকি যাওয়া দরকার। কিন্তু তা হলে আর তুমি ‘তুমি’ থাকবে না। তুমি যা বলতে চাও, তা বললে ওরা তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবে না। চুটকি-ফুটকি বলতে পারো, আমার কাছে লোকে এক সময়ে তা-ই আশা করত। আমি অবশ্য সত্যি-সত্যি মনে করি না যে সব লোকই এ রকম। তবু তারা এ রকম করে কেন?
আ মা র খ্যা তি
বিট্লদের একজন হিশেবে আমার কোন দিন কোন সচেতনতা ছিল না। আমি আমিই। আমি বিখ্যাত নই। লোকে আমায় বিখ্যাত বানিয়েছে। তারা কাছাকাছি এসে হুটোপাটি না-করলে এ সব আমার মনে থাকে না। হঠাৎ মনে হয়, আরে, লোকে এত অদ্ভত ব্যবহার করছে কেন? তখন আমার মনে পড়ে যে, ও, আমি তো বিট্ল।
বছর-কয়েক আগে এ সবে আমরা বেশ অভ্যস্ত ছিলাম, নানা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি, সব সময়ে কারও-না-কারও সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে, আর তারা তোমায় তাকিয়ে দেখছে। এখন আর আমি ওর মধ্যে নেই, পরিচিত লোক ছাড়া কারও সঙ্গে কোথাও যাই না।
বিখ্যাত হওয়ার আগেই লোকে অবশ্য আমাদের দেখত। গিটার নিয়ে বাস-এ যাচ্ছি। ক্যাভার্ন-এ অনুষ্ঠান আছে। তখন ভালো লাগত। তখন তার মধ্যে একটা বিদ্রোহের ব্যাপার ছিল।
ছোটখাটো মজা করতে আমার সব সময়ে মজা ভাল্লাগে। কিন্তু এখন ইচ্ছে করলেও তা আর করতে পারি না। অমনি সেটা খবর হয়ে যাবে।
এক সময়ে আমরা ছদ্মবেশে ঘুরব বলে ভেবেছিলাম। লম্বা কোট পরে আর দাড়ি লাগিয়ে কাস্টমস অফিসে গিয়ে ভাবছি, কেউ আমাদের চিনতে পারছে না। ও বাবা, কোথায় কী? সবাই দেখি, দিব্যি চিনেছে।
আমি এখন একেবারে একা থাকতে চাই। কোন দিনই আমি খুব মিশুকে ছিলাম না। আমার তথাকথিত বহির্মুখী চরিত্রের ব্যাপারটা পুরো মিথ্যে। কোন দিনই আমি উচ্চকণ্ঠ ছিলাম না, এত দিন স্রেফ আত্মরক্ষার বর্ম হিশেবেই তা ব্যবহার করে এসেছি। তার মূল্য আমায় এখন দিতে হচ্ছে। জানি, কথাটা এখন শোনাচ্ছে প্রায় বিলাপের মতো।
আ মা র টা কা প য় সা
কত টাকা আমি রোজগার করেছি আমি জানি না। বাগানের নিচে কোথায় সিন্দুক-ভর্তি সম্পদ লুকনো আছে, সে সম্পর্কে আমার কোন চেতনা নেই। সবটাই কাল্পনিক, তবে লোকে যতটা ভাবে ততটা যে নয়, তা আমি জানি।
এ সব নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে, নানা চেহারায়, একবার অ্যাকাউন্ট্যান্ট-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সব মিলিয়ে কত হবে? একটুকরো কাগজে সেটা লিখে রেখেছিলাম। কাগজটা আর খুঁজে পাচ্ছি না।
অল্প বয়সে সাফল্য জুটে গেছে বলে আমি বেঁচে গেছি। তার মানে বাদবাকি জীবনে সত্যি-সত্যি যা আমি করতে চাই, তা-ই করতে পারি। শুধু সাফল্যের জন্য গোটা জীবন বরবাদ হয়ে যাওয়াটা সাংঘাতিক।
আমরা সব সময়ে ছোট-ছোট নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে এগিয়েছি, তার বেশি আর ভাবতে যাইনি। কখনও বড় কিছু ভাবিনি। বরং এখন আমি তা পারি, এখন আর আমি ছোট-ছোট খেপে বিশ্বাস করি না।
আ মা র নি র্বা ণ
আমার ধারণা আমি এখন বৌদ্ধ নির্বাণে আগ্রহী। এ নিয়ে যে আমি খুব কিছু জানি, তা নয়। তেমন কিছু বুঝিও না যে ব্যাখ্যা করে বোঝাব।
ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা আমাকে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে শিখিয়েছে, রুক্ষ না-হতে শিখিয়েছে। নিজেকে পালটানোর কোন সচেতন চেষ্টা নয় এটা, বা হয়তো তা-ই। জানি না। যা আমি হতে চাই, আমি স্রেফ তা-ই হতে চেষ্টা করছি।
মাদক সম্ভবত আমায় নিজেকে বুঝতে সাহায্য করেছে। ছিলিম নয়। ও ছিল খানিকটা নির্দোষ হাসাহাসি। এলএসডি-ই হল আত্মজ্ঞান, যা পথ দেখিয়েছে। প্রথম নেওয়ার সময়ে হঠাৎই আমার সেই মহাদর্শন হয়। কিন্তু তা হওয়ার আগে এ নিয়ে তোমার খোঁজটা থাকতে হবে। হয়তো আমি খুঁজছিলাম, জানতাম না। তারপর খুঁজে পেলামও, শুধু অনেকটা সময় তাতে লেগে গেল।
কিন্তু এখানে পৌঁছনোর আরও অনেক ভালো উপায় আছে। খ্রিস্টীয় মত ও পথের বিরুদ্ধে আমার তেমন কিছু বলার নেই। আমার ধারণা, যিশু সম্পর্কে এখন আর কোন খারাপ মন্তব্য আমি করব না। এখন আমি অন্য ভাবে ভাবি। বৌদ্ধ মত অবশ্য আরও সরল আর যৌক্তিক, কিন্তু যিশুর বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই। জুলিয়ান-কে আমি যিশু সম্পর্কে সব কিছু জানতে বলব, কিন্তু সেই সঙ্গে বলব, যিশুর মতো আরও বহু লোক আছে, বৌদ্ধদের কথা বলব, তারাও ভালো লোক।
যিশু সম্পর্কে মন্তব্য করার পর যিশু সম্পর্কে অনেক বই আমাকে অনেকে পাঠিয়েছে, তার থেকে বহু কিছু আমি জেনেছি। যেমন জেনেছি যে ইংল্যান্ড-এর চার্চ মোটেই খুব ধার্মিক নয়। বড় বেশি রাজনীতি ওখানে। একই সঙ্গে ক্ষমতাধর আর শুদ্ধচিত্ত হওয়া সম্ভব নয়। হয়তো দেখা যাবে গুরুরাও তা-ই, রাজনীতিতে ওস্তাদ। কে জানে?
আমি জানি না গরিব হলে বিশেষ কোন সুবিধে হয় কি না। আমার মনে হয়, আমি সব ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু তার আগে আরও অপেক্ষা করতে হবে, দেখতে হবে কীসের জন্যে আমি ত্যাগ করব, ফাঁকা জায়গাটা ভরাব কী দিয়ে। শেষ পর্যন্ত এ সব জড় বস্তু আমি হয়তো ত্যাগ করব, কিন্তু আপাতত আমি নিজেকে খুঁজে পেতে চাই।
হান্টার ডেভিস, দ্য বিট্লস, অ্যারো বুকস, ১৯৯২
মনফকিরা-প্রকাশিত জন লেনন-এর গান আর সাক্ষাৎকার-এর সংকলন ‘গান ছাড়া জানি না কিছুই’ বইয়ে সংকলিত। ভাষান্তর: সন্দীপন ভট্টাচার্য।
(এখানে প্রকাশিত লেখাপত্র শুধুই পড়ার জন্য। দয়া করে এর কোন অংশ কোথাও পুনর্মুদ্রণ করবেন না। ইচ্ছে করলে লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু অনুরোধ, গোটা লেখাটি কখনওই অন্য কোন ওয়েবসাইটে বা কোন সোশ্যাল নেটওয়রকিং সাইটে শেয়ার করবেন না। ধন্যবাদ।)