ছাঁচের গভীর থেকে : মীরা মুখোপাধ্যায়
অন্ধকার সাঁতরে পেলাম ঘড়িটি। আমার ভয়শূন্যতার হেতু ধনুর্বাণের ছিলার মতো পথপ্রদর্শক এক ফালি চাঁদের আলো। দেখি, যামিনী তৃতীয় প্রহরে পা দিতে যাচ্ছে। দ্রুত দুয়ার উন্মুক্ত করা মাত্র, চন্দ্রালোকে প্লাবিত রূপসী নিশি স্তব্ধ করে দিল। সিত বিভাষায় আর শিশিরবিন্দুতে সজ্জিত কলাবধূরা শরমিত। এত রূপ, লক্ষকোটি তারকারাজি নেমে এসে যেন নিভৃতে নিঃশব্দে ইঙ্গিতে অনামা এক রাগিণীতে গেয়ে চলেছে। এই হিমশীতল শবরীর নিঃশেষিত আলোর ঝরনায় মনের গ্লানি সব ধুয়ে গেল।
নিভৃতে রাত্রি তুমি দাত্রী হয়ে আমার নয়নকে ধন্য করেছ। আমি আশঙ্কিত। দিনের গভীরে তা হারিয়ে ফেলি যদি। সহকর্মীদের নিদ্রাভঙ্গ করে আঙিনায় নিয়ে এলাম। জ্যোৎস্নায় দুটি গ্রহের মতো জেগে আছে একটি গোলাকৃতি গহ্বরে রাখা মৃন্ময়ী আধারের ছাঁচ। তার অন্তর্নিহিত মোমের ্রপ্সিত মূর্তিটি। নানারকম গাছ ও ভিন্ন আকৃতিপ্রকৃতির বস্তুতে আলোছায়ায় স্থানটিকে সমে্মাহিত করেছে।
ধীরে-ধীরে কখনও কাঠ, কখনও অন্য জালানি দিয়ে অগ্নিসংযোগে প্রথম কাজের সূচনা। কয়েক ঘণ্টা পর, তখনও ঊষা স্পর্শ করেনি পুবাকাশ– কেমন যেন বহুকালের পরিচিত গন্ধ, জালানি ধোঁয়ার গন্ধ। আগুন জ্বলছে। তারা শিরোবেষ্টিত হয়ে বসেছিল। সাঁওতাল পরগনায় বসেছিল, পুরীর চক্রতীর্থের বাড়ির ধারে বসেছিল, বসেছিল পাহাড়ে-পর্বতে, নদীকূলে। আগুন জ্বলছে– ঘিরে শিরোবেষ্টিত হয়ে আজও বসে আছে ছেলেরা।
এর পর দ্রুতলয়ে চলল আমাদের কাজ। কখনও বেগে, কখনও রুদ্ধশ্বাসে, কখনও ত্রস্ত ব্যস্ততায়। নিশান্তে প্রত্যূষের আলো শুভ্র আনন্দে ফোটা ফুলটির মতো দিবসব্যাপী একটা সময়ের পাপড়ি থেকে আর-একটা খুলে গেল কখন। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ করতে-করতে চলে এলাম দিনান্তে। আমাদের বিস্মরণে ক্লান্তি, জেগে উঠি নতুন প্রাণে– সাজ-সাজ রব। সময় হল। এবার ঢালাই। ভাববার সময় যদি পেয়েছি তবে শুধু কয়েকবারই ভেবেছি, মধ্যারাত্রের দৃশ্য হারিয়ে যায়নি, ফুটন্ত দিনের সম্পূর্ণতায় লুকিয়ে দেখা দিয়ে গেছে। আর? চোখের সামনে ‘সে’! সমানে শাসিয়ে যাচ্ছে–’ভয় আছে। সাবধান!’ স্মৃতিকে উত্তেজিত করে রেখেছে। সে জ্বলন্ত ছাঁচের অন্তর্নিহিত গভীর থেকে উদ্ভূত, আমার মতোই সে সতেজ প্রাণী। যখন ছাঁচ অনতিতপ্ত, তখন ভাঙা শুরু হয়। এই উন্মুখ ক্ষণটির জন্য অধীর প্রতীক্ষায় থাকি। আচ্ছাদিত মৃন্ময়ী আধারটিকে চূর্ণ বিদীর্ণ করতে-করতে অন্তর্নিহিত পিতলের মূর্তিটির আবির্ভাব হয়। তখন অনির্বচনীয় আনন্দে প্রাণ আপ্লুত হয়। কিন্তু যদি মূর্তিটির খুঁত আসে, বিকৃত হয়, তবে ততোধিক দুঃখে প্লাবিত হই। প্রাণ আর্তনাদ করে ওঠে। সহচরদের দুঃখ থেকে অব্যাহতি দিতে, অন্তরের দুঃখ অভ্যন্তরেই অজ্ঞাত রাখতে হয়।
ঢালাইকর্ম চলাকালীন আমার মন-প্রাণ ওতপ্রোতভাবে ছাঁচের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এই অবিচ্ছেদ্যতায় কতকগুলি অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা প্রতিভাত হতে পারে অদ্ভুত, বিস্ময়কর। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলি আমার কর্মের বিশেষ সহায়ক হয়েছে। কখনও যদি হাওয়া-নালি ভ্রমবশত ভুল স্থানে দিয়ে থাকি এবং ছাঁচ জ্বলাকালীন ভিতরে যে-হাওয়া সৃষ্টি হয় তা নিষ্কাশনের জন্য সুগম ব্যবস্থা না-হয়ে থাকে, তবে ছাঁচের যে-পরিস্থিতি হয় তা আমাকে ওই মৃন্ময় আধারটি জানিয়ে দেয়। শ্বাসরোধে যে-কষ্ট, সেই কষ্টে উক্ত জলন্ত ছাঁচটি ছটফট করে থাকে। ছটফট করেছি আমিও। কী করে এ অবস্থাকে লঙঘন করব বুঝতে পারিনি। অথচ বিপদসঙ্কুল এ অবস্থা।
যে আমাকে বিপদসঙ্কেত করে, কে সে? উত্তাপে মৃন্ময়ী ছাঁচ থেকে যে-প্রাণ উদ্ভূত হয়, সে আমাকে সাবধানী সংকেত করে চলে।
ঐ মানসী মূর্তিটি আমার অঙ্গুলি দিয়ে, মোম দিয়ে রচিত। রচনাটি আমার সমস্ত সত্তাকে উন্মোচন করেছে। ্রপ্সিত বস্তুটিকে ধাতুতে হুবহু রূপান্তরিত করবার জন্য কয়েকরকম মাটির চাদর দিয়ে মোমের মূর্তিটিকে মোড়া হয়েছে।
যে-সব মৌলিক পদার্থ ও বস্তু মিশ্রণ করে এই ছাঁচ তৈরি হয়, তা হচ্ছে দু’তিন রকমের মাটি, ভূষি, বালি, লোহা, মোম, ধূনা, কাঠ, গোময়, তেল ইত্যাদি। এগুলির সমষ্টিগুণ যখন বিশেষ উত্তপ্ত হয়, হয়তো তা মানুষের প্রাণের মতোই, তাই এই দুই-ই নতুনভাবে জাগ্রত হয়, তার দরুন ভাবের আদানপ্রদান হয়। যদি এ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক কাজ হয়, তবেই এর সত্য একদিন প্রমাণিত হবে। এমনিতেই ধাতুর এক রহস্যময় দিক আছে। ধাতু মনে হয় বড় খেয়ালি এবং কোনরকম অযত্ন; সহ্য করে না। অতি সাবধানে ও একাগ্র হয়ে এই কার্য নির্বাহ করতে হয়।
আগুনও তাই, কী জানি কী হয়! কখনও অসম্ভব সম্ভব হয়। কখনও অনায়াসে যা হবে মনে করেছি, তা যেন কর্মঘাতী হয়ে কর্ম অসফল করে। এই সূত্রে একটি ঘটনা বলি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা– তখন ছাঁচ পাকানোর সময় ঢাকা পড়ত না, আমি আঁচের পাশে বসে থাকতাম। জালানি দিয়ে ছাঁচটি আচ্ছাদিত করে বসে থাকতাম। ঝোড়ো হাওয়া ছিল না সেদিন– গাছগুলি স্থির, শান্তভাবে দাঁড়িয়ে, অথচ দেখি জালানির ধোঁয়া যেখানে-যেখানে লাগছে, সেইখানে সেই ডালগুলি অথবা পাতাগুলি থরথর করে কাঁপছে, দহনজ্বালায় দুলছে। সেই থেকে স্পষ্ট হল– ঐ অগ্নিময় ধোঁয়াতে গাছগুলির কষ্ট হয়। আর-একদিন ঠিক ঐভাবে বসে আছি, জালানি দেবার পর তা প্রজ্বলিত হয়ে লেলিহান শিখা চারিদিকে ছোট-বড় জ্বলছে। ক্রমে এই সব শিখা তেজোময় অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হল। এমন সময়ে একটি হলুদ রঙের প্রজাপতি যেন আনন্দে নৃত্য করতে এল। ক্ষণেক পর প্রজাপতিটি সেই অগ্নিকুণ্ডের ইট-চক্রের ঘেরের উপর বসল। আমি অতি উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে উড়িয়ে দিলাম। সে বেগে উড়ে দূরে চলে গেল। ক্ষণেক পর আবার সেই সুন্দর প্রজাপতিটি ঐ স্থানে ফিরে এল। এবার সে কোথাও বসল না, কোথাও গেল না। তাপ লাগার আগেই দূর থেকে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিল। প্রজাপতিটি কেন আত্মহত্যা করল, জানিনে। হয়তো সুখদুঃখাতীত তেজোময় অগ্নি তাকে আকর্ষণ করেছিল।
সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ কিন্তু বিপদসঙ্কুল হলেও আনন্দ বিতরণ করে। প্রত্যূষে এবং দিবসকালে সমুদ্রতটে কতরকম আনন্দের লহরী কালকে প্রীত করে। শিশুদের উল্লসিত হাসি যেন চারিদিক তরঙ্গায়িত করে। পাখিদের গান, শিশুদের খিলখিল হাসি, সমুদ্রগর্জনও হো-হো হা-হা করে হাসতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে খুশির প্রভাব। স্থানীয় শিশুদের ও কিশোর বালকদের আনন্দধ্বনিও যেন সমুদ্রের মহাজাগতিক একটি মাত্র সুরের বিস্তার– সেগুলি যেন কোথাও-কোথাও অলঙ্কার। কোথায় এ বিস্তারের শুরু, জানিনে আমরা। কী করে এই বিচ্ছুরিত ধ্বনির চির-সংরক্ষিত শক্তির অভিক্ষরণ মানুষের প্রাণ স্পর্শ করে চৈতন্যকে জাগিয়ে তুলবে, চৈতন্যময়ী?
মীরা মুখোপাধ্যায়-এর রচনা ও সাক্ষাৎকারের একমাত্র সংকলন ‘প্রবাহিত জীবনের ভাস্কর্য’ থেকে।
(এখানে প্রকাশিত লেখাপত্র শুধুই পড়ার জন্য। দয়া করে এর কোন অংশ কোথাও পুনর্মুদ্রণ করবেন না। ইচ্ছে করলে লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু অনুরোধ, গোটা লেখাটি কখনওই অন্য কোন ওয়েবসাইটে বা কোন সোশ্যাল নেটওয়রকিং সাইটে শেয়ার করবেন না। ধন্যবাদ।)