Customize Consent Preferences

We use cookies to help you navigate efficiently and perform certain functions. You will find detailed information about all cookies under each consent category below.

The cookies that are categorized as "Necessary" are stored on your browser as they are essential for enabling the basic functionalities of the site. ... 

Always Active

Necessary cookies are required to enable the basic features of this site, such as providing secure log-in or adjusting your consent preferences. These cookies do not store any personally identifiable data.

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ছবির অঙ্গ

এক বলিলেন বহু হইব , এমনি করিয়া সৃষ্টি হইল — আমাদের সৃষ্টিতত্ত্বে এই কথা বলে ।

একের মধ্যে ভেদ ঘটিয়া তবে রূপ আসিয়া পড়িল । তাহা হইলে রূপের মধ্যে দুইটি পরিচয় থাকা চাই , বহুর পরিচয় , যেখানে ভেদ ; এবং একের পরিচয় , যেখানে মিল । জগতে রূপের মধ্যে আমরা কেবল সীমা নয় সংযম দেখি । সীমাটা অন্য সকলের সঙ্গে নিজেকে তফাত করিয়া , আর সংযমটা অন্য সমস্তের সঙ্গে রফা করিয়া । রূপ এক দিকে আপনাকে মানিতেছে , আর – এক দিকে অন্য সমস্তকে মানিতেছে তবেই সে টিঁকিতেছে ।

তাই উপনিষৎ বলিয়াছেন , সূর্য ও চন্দ্র , দ্যুলোক ও ভূলোক , একের শাসনে বিধৃত । সূর্য চন্দ্র দ্যুলোক ভূলোক আপন-আপন সীমায় খণ্ডিত ও বহু — কিন্তু তবু তার মধ্যে কোথায় এককে দেখিতেছি ? যেখানে প্রত্যেকে আপন-আপন ওজন রাখিয়া চলিতেছে ; যেখানে প্রত্যেকে সংযমের শাসনে নিয়ন্ত্রিত । ভেদের দ্বারা বহুর জন্ম কিন্তু মিলের দ্বার বহুর রক্ষা । যেখানে অনেককে টিঁকিতে হইবে সেখানে প্রত্যেককে আপন পরিমাণটি রাখিয়া আপন ওজন বাঁচাইয়া চলিতে হয় । জগৎসৃষ্টিতে সমস্ত রূপের মধ্যে অর্থাৎ সীমার মধ্যে পরিমাণের যে সংযম সেই সংযমই মঙ্গল সেই সংযমই সুন্দর । শিব যে যতী ।

আমরা যখন সৈন্যদলকে চলিতে দেখি তখন এক দিকে দেখি প্রত্যেকে আপন সীমার দ্বারা স্বতন্ত্র আর এক দিকে দেখি প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট মাপ রাখিয়া ওজন রাখিয়া চলিতেছে । সেইখানেই সেই পরিমাণের সুষমার ভিতর দিয়া জানি ইহাদের ভেদের মধ্যেও একটি এক প্রকাশ পাইতেছে । সেই এক যতই পরিস্ফুট এই সৈন্যদল ততই সত্য । বহু যখন এলোমেলো হইয়া ভিড় করিয়া পরস্পরকে ঠেলাঠেলি ও অবশেষে পরস্পরকে পায়ের তলায় দলাদলি করিয়া চলে তখন বহুকেই দেখি , এককে দেখিতে পাই না , অর্থাৎ তখন সীমাকেই দেখি ভূমাকে দেখি না — অথচ এই ভূমার রূপই কল্যাণরূপ , আনন্দরূপ ।

নিছক বহু কি জ্ঞানে কি প্রেমে কি কর্মে মানুষকে ক্লেশ দেয় , ক্লান্ত করে , এই জন্য মানুষ আপনার সমস্ত জানায় চাওয়ায় পাওয়ায় করায় বহুর ভিতরকার এককে খুঁজিতেছে — নহিলে তার মন মানে না , তার সুখ থাকে না , তার প্রাণ বাঁচে না । মানুষ তার বিজ্ঞানে বহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন নিয়মকে পায় , দর্শনে বহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন তত্ত্বকে পায় , সাহিত্যে শিল্পে বহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন সৌন্দর্যকে পায় , সমাজে বহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন কল্যাণকে পায় । এমনি করিয়া মানুষ বহুকে লইয়া তপস্যা করিতেছে এককে পাইবার জন্য ।

এই গেল আমার ভূমিকা । তার পরে , আমাদের শিল্পশাস্ত্র চিত্রকলা সম্বন্ধে কী বলিতেছে বুঝিয়া দেখা যাক ।

সেই শাস্ত্রে বলে , ছবির ছয় অঙ্গ । রূপভেদ , প্রমাণ , ভাব , লাবণ্য , সাদৃশ্য ও বর্ণিকাভঙ্গ ।

‘ রূপভেদাঃ ‘ — ভেদ লইয়া শুরু । গোড়ায় বলিয়াছি ভেদেই রূপের সৃষ্টি । প্রথমেই রূপ আপনার বহু বৈচিত্র্য লইয়াই আমাদের চোখে পড়ে । তাই ছবির আরম্ভ হইল রূপের ভেদে — একের সীমা হইতে আরের সীমার পার্থক্যে ।

কিন্তু শুধু ভেদে কেবল বৈষম্যই দেখা যায় । তার সঙ্গে যদি সুষমাকে না দেখানো যায় তবে চিত্রকলা তো ভূতের কীর্তন হইয়া উঠে । জগতের সৃষ্টিকার্যে বৈষম্য এবং সৌষম্য রূপে রূপে একেবারে গায়ে গায়ে লাগিয়া আছে ; আমাদের সৃষ্টিকার্যে যদি তার সেটা অন্যথা ঘটে তবে সেটা সৃষ্টিই হয় না , অনাসৃষ্টি হয় ।

বাতাস যখন স্তব্ধ তখন তাহা আগাগোড়া এক হইয়া আছে । সেই এককে বীণার তার দিয়া আঘাত করো তাহা ভাঙিয়া বহু হইয়া যাইবে । এই বহুর মধ্যে ধ্বনিগুলি যখন পরস্পর পরস্পরের ওজন মানিয়া চলে তখন তাহা সংগীত , তখনই একের সহিতঅন্যের সুনিয়ত যোগ — তখনই সমস্ত বহু তাহার বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়া একই সংগীত প্রকাশ করে । ধ্বনি এখানে রূপ , এবং ধ্বনির সুষমা যাহা সুর তাহাই প্রমাণ । ধ্বনির মধ্যে ভেদ , সুরের মধ্যে এক ।

এইজন্য শাস্ত্রে ছবির ছয় অঙ্গের গোড়াতে যেখানে ‘ রূপভেদ ‘ আছে সেইখানেই তার সঙ্গে সঙ্গে ‘ প্রমাণানি ‘ অর্থাৎ পরিমাণ জিনিসটাকে একেবারে যমক করিয়া সাজাইয়াছে । ইহাতে বুঝিতেছি ভেদ নইলে মিল হয় না এই জন্যই ভেদ , ভেদের জন্য ভেদ নহে ; সীমা নহিলে সুন্দর হয় না এই জন্যই সীমা , নহিলে আপনাতেই সীমার সার্থকতা নাই , ছবিতে এই কথাটাই জানাইতে হইবে । রূপটাকে তার পরিমাণে দাঁড় করানো চাই । কেননা আপনার সত্য মাপে যে চলিল অর্থাৎ চারি দিকের মাপের সঙ্গে যার খাপ খাইল সেই হইল সুন্দর । প্রমাণ মানে না যে রূপ সেই কুরূপ , তাহা সমগ্রের বিরোধী ।

রূপের রাজ্যে যেমন জ্ঞানের রাজ্যেও তেমনি । প্রমাণ মানে না যে যুক্তি সেই তো কুযুক্তি । অর্থাৎ সমস্তের মাপকাঠিতে যার মাপে কমিবেশি হইল , সমস্তের তুলাদণ্ডে যার ওজনের গরমিল হইল সেই তো মিথ্যা বলিয়া ধরা পড়িল । শুধু আপনার মধ্যেই আপনি তো কেহ সত্য হইতে পারে না , তাই যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণ করার মানে অন্যকে দিয়া এককে মাপা । তাই দেখি সত্য এবং সুন্দরের একই ধর্ম । এক দিকে তাহা রূপের বিশিষ্টতায় চারি দিক হইতে পৃথক ও আপনার মধ্যে বিচিত্র , আর-এক দিকে তাহা প্রমাণের সুষমায় চারিদিকের সঙ্গে ও আপনার মধ্যে সামঞ্জস্যে মিলিত । তাই যারা গভীর করিয়া বুঝিয়াছে তারা বলিয়াছে সত্যই সুন্দর , সুন্দরই সত্য ।

ছবির ছয় অঙ্গের গোড়ার কথা হইল রূপভেদাঃ প্রমাণানি । কিন্তু এটা তো হইল বহিরঙ্গ — একটা অন্তরঙ্গও তো আছে ।

কেননা , মানুষ তো শুধু চোখ দিয়া দেখে না , চোখের পিছনে তার মনটা আছে । চোখ ঠিক যেটি দেখিতেছে মন যে তারই প্রতিবিম্বটুকু দেখিতেছে তাহা নহে । চোখের উচ্ছিষ্টেই মন মানুষ এ কথা মানা চলিবে না — চোখের ছবিতে মন আপনার ছবি জুড়িয়া দেয় তবেই সে ছবি মানুষের কাছে সম্পূর্ণ হইয়া ওঠে ।

তাই শাস্ত্র ‘ রূপভেদাঃ প্রমাণানি ‘ তে ষড়ঙ্গের বহিরঙ্গ সারিয়া অন্তরঙ্গের কথায় বলিতেছেন — ‘ ভাবলাবণ্য যোজনং ‘ — চেহারার সঙ্গে ভাব ও লাবণ্য যোগ করিতে হইবে — চোখের কাজের উপরে মনের কাজ ফলাইতে হইবে ; কেননা শুধু কারু কাজটা সামান্য , চিত্র করা চাই — চিত্রের প্রধান কাজই চিৎকে দিয়া ।

ভাব বলিতে কী বুঝায় তাহা আমাদের এক রকম সহজে জানা আছে । এই জন্যই তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টায় যাহা বলা হইবে তাহাই বুঝা শক্ত হইবে । স্ফটিক যেমন অনেকগুলা কোণ লইয়া দানা বাঁধিয়া দাঁড়ায় তেমনি ‘ ভাব ‘ কথাটা অনেকগুলা অর্থকে মিলাইয়া দানা বাঁধিয়াছে । এ সকল কথার মুশকিল এই যে , ইহাদের সব অর্থ আমরা সকল সময়ে পুরাভাবে ব্যবহার করি না , দরকার মত ইহাদের অর্থচ্ছটাকে ভিন্ন পর্যায়ে সাজাইয়া এবং কিছু কিছু বাদসাদ দিয়া নানা কাজে লাগাই । ভাব বলিতে feeling, ভাব বলিতে idea, ভাব বলিতে characteristics, ভাব বলিতে suggestion, এমন আরো কত কী আছে ।

এখানে ভাব বলিতে বুঝাইতেছে অন্তরের রূপ । আমার একটা ভাব তোমার একটা ভাব ; সেইভাবে আমি আমার মতো , তুমি তোমার মতো । রূপের ভেদ যেমন বাহিরের ভেদ , ভাবের ভেদ তেমনি অন্তরের ভেদ । রূপের ভেদ সম্বন্ধে যে কথা বলা হইয়াছে ভাবের ভেদ সম্বন্ধেও সেই কথাই খাটে । অর্থাৎ কেবল যদি তাহা এক-রোখা হইয়া ভেদকেই প্রকাশ করিতে থাকে তবে তাহা বীভৎস হইয়া উঠে । তাহা লইয়া সৃষ্টি হয় না , প্রলয়ই হয় । ভাব যখন আপন সত্য ওজন মানে অর্থাৎ আপনার চারি দিককে মানে, বিশ্বকে মানে , তখনই তাহা মধুর । রূপের ওজন যেমন তাহার প্রমাণ , ভাবের ওজন তেমনি তাহার লাবণ্য ।

কেহ যেন না মনে করেন ভাব কথাটা কেবল মানুষের সম্বন্ধেই খাটে । মানুষের মন অচেতন পদার্থের মধ্যেও একটা অন্তরের পদার্থ দেখে । সেই পদার্থটা সেই অচেতনের মধ্যে বস্তুতই আছে কিংবা আমাদের মন সেটাকে সেইখানে আরোপ করে সে হইলতত্ত্বশাস্ত্রের তর্ক , আমার তাহাতে প্রয়োজন নাই । এইটুকু মানিলেই হইল স্বভাবতই মানুষের মন সকল জিনিসকেই মনের জিনিস করিয়া লইতে চায় ।

তাই আমরা যখন একটা ছবি দেখি তখন এই প্রশ্ন করি এই ছবির ভাবটা কী ? অর্থাৎ ইহাতে তো হাতের কাজের নৈপুণ্য দেখিলাম , চোখে দেখার বৈচিত্র্য দেখিলাম , কিন্তু ইহার মধ্যে চিত্তের কোন্‌ রূপ দেখা যাইতেছে — ইহার ভিতর হইতে মন মনের কাছে কোন্‌ লিপি পাঠাইতেছে ? দেখিলাম একটা গাছ — কিন্তু গাছ তো ঢের দেখিয়াছি , এ গাছের অন্তরের কথাটা কী , অথবা যে আঁকিল গাছের মধ্য দিয়া তার অন্তরের কথাটা কী সেটা যদি না পাইলাম তবে গাছ আঁকিয়া লাভ কিসের ? অবশ্য উদ্ভিদ্‌তত্ত্বের বইয়ে যদি গাছের নমুনা দিতে হয় তবে সে আলাদা কথা । কেননা সেখানে সেটা চিত্র নয় সেটা দৃষ্টান্ত ।

শুধু-রূপ শুধু-ভাব কেবল আমাদের গোচর হয় মাত্র । ‘ আমাকে দেখো ‘ ‘ আমাকে জানো ‘ তাহাদের দাবি এই পর্যন্ত । কিন্তু ‘ আমাকে রাখো ‘ এ দাবি করিতে হইলে আরো কিছু চাই । মনের আম-দরবারে আপন-আপন রূপ লইয়া ভাব লইয়া নানা জিনিস হাজির হয় , মন তাহাদের কাহাকেও বলে , ‘ বসো ‘ , কাহাকেও বলে ‘ আচ্ছা যাও ‘ ।

যাহারা আর্টিস্ট তাহাদের লক্ষ্য এই যে , তাহাদের সৃষ্ট পদার্থ মনের দরবারে নিত্য আসন পাইবে । যে সব গুণীর সৃষ্টিতে রূপ আপনার প্রমাণে , ভাব আপনার লাবণ্যে , প্রতিষ্ঠিত হইয়া আসিয়াছে তাহারাই ক্লাসিক হইয়াছে , তাহারাই নিত্য ইহয়াছে ।

অতএব চিত্রকলায় ওস্তাদের ওস্তাদি , রূপে ও ভাবে তেমন নয় , যেমন প্রমাণে ও লাবণ্যে । এই সত্য-ওজনের আন্দাজটি পুঁথিগত বিদ্যায় পাইবার জো নাই । ইহাতে স্বাভাবিক প্রতিভার দরকার । দৈহিক ওজনবোধটি স্বাভাবিক হইয়া উঠিলে তবেই চলা সহজ হয় । তবেই নূতন নূতন বাধায় , পথের নূতন নূতন আঁকেবাঁকে আমরা দেহের গতিটাকে অনায়াসে বাহিরের অবস্থার সঙ্গে তানে লয়ে মিলাইয়া চলিতে পারি । এই ওজনবোধ একেবারে ভিতরের জিনিস যদি না হয় তবে রেলগাড়ির মতো একই বাঁধা রাস্তায় কলের টানে চলিতে হয় , এক ইঞ্চি ডাইনে বাঁয়ে হেলিলেই সর্বনাশ । তেমনি রূপ ও ভাবের সম্বন্ধে যার ওজনবোধ অন্তরের জিনিস সে ‘নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধি ‘ র পথে কলাসৃষ্টিকে চালাইতে পারে । যার সে বোধ নাই সে ভয়ে ভয়ে একই বাঁধা রাস্তায় ঠিক এক লাইনে চলিয়া পঞ্চটো হইয়া কারিগর হইয়া ওঠে , সে সীমার সঙ্গে সীমার নূতন সম্বন্ধ জমাইতে পারে না । এই জন্য নূতন সম্বন্ধমাত্রকে সে বাঘের মতো দেখে ।

যাহা হউক এতক্ষণ ছবির ষড়ঙ্গের আমরা দুটি অঙ্গ দেখিলাম , বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ । এইবার পঞ্চম অঙ্গে বাহির ও ভিতর যে-কোঠায় এক হইয়া মিলিয়াছে তাহার কথা আলোচনা করা যাক । সেটার নাম ‘ সাদৃশ্যং ‘ । নকল করিয়া যে সাদৃশ্য মেলে এতক্ষণে সেই কথাটা আসিয়া পড়িল এমন যদি কেহ মনে করেন তবে শাস্ত্রবাক্য তাঁহার পক্ষে বৃথা হইল । ঘোড়াগোরুকে ঘোড়াগোরু করিয়া আঁকিবার জন্য রেখা প্রমাণ ভাব লাবণ্যের এত বড়ো উদ্‌যোগপর্ব কেন ? তাহা হইলে এমন কথাও কেহ মনে করিতে পারেন উত্তর-গোগৃহে গোরু-চুরি কাণ্ডের জন্যই উদ্‌যোগ পর্ব , কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের জন্য নহে ।

সাদৃশ্যের দুইটা দিক আছে ; একটা , রূপের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য ; আর একটা ভাবের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য। একটা বাহিরের, একটা ভিতরের । দুটাই দরকার । কিন্তু সাদৃশ্যকে মুখ্যভাবে বাহিরের বলিয়া ধরিয়া লইলে চলিবে না ।

যখনই রেখা ও প্রমাণের কথা ছাড়াইয়া ভাব লাবণ্যের কথা পাড়া হইয়াছে তখনই বোঝা গিয়াছে গুণীর মনে যে ছবিটি আছে সে প্রধানত রেখার ছবি নহে তাহা রসের ছবি। তাহার মধ্যে এমন একটি অনির্বচনীয়তা আছে যাহা প্রকৃতিতে নাই । অন্তরের সেই অমৃতরসের ভাবচ্ছবিকে বাহিরে দৃশ্যমান করিতে পারিলে তবেই রসের সহিত রূপের সাদৃশ্য পাওয়া যায় , তবেই অন্তরের সহিত বাহিরের মিল হয় । অদৃশ্য তবেই দৃশ্যে আপনার প্রতিরূপ দেখে । নানারকম চিত্রবিচিত্র করা গেল , নৈপুণ্যের অন্ত রহিল না, কিন্তু ভিতরের রসের ছবির সঙ্গে বাহিরের রূপের ছবির সাদৃশ্য রহিল না ; রেখাভেদ ও প্রমাণের সঙ্গে ভাব ও লাবণ্যের জোড় মিলিল না;হয়তো রেখার দিকে ত্রুটি রহিল নয়তো ভাবের দিকে — পরস্পর পরস্পরের সদৃশ হইল না । বরও আসিল কনেও আসিল , কিন্তু অশুভ লগ্নে মিলনের মন্ত্র ব্যর্থ হইয়া গেল । মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ , বাহিরের লোক হয়তো পেট ভরিয়া সন্দেশ খাইয়া খুব জয়ধ্বনি করিল কিন্তু অন্তরের খবর যে জানে সে বুঝিল সব মাটি হইয়াছে ; চোখ-ভোলানো চাতুরীতেই বেশি লোক মজে , কিন্তু , রূপের সঙ্গে রসের সাদৃশ্যবোধ যার আছে , চোখের আড়ে তাকাইলেই যে লোক বুঝিতে পারে রসটি রূপের মধ্যে ঠিক আপনার চেহারা পাইয়াছে কি না , সেই তো রসিক । বাতাস যেমন সূর্যের কিরণকে চারি দিকে ছড়াইয়া দিবার কাজ করে তেমনি গুণীর সৃষ্ট কলাসৌন্দর্যকে লোকালয়ের সর্বত্র ছড়াইয়া দিবার ভার এই রসিকের উপর । কেননা যে ভরপুর করিয়া পাইয়াছে সে স্বভাবতই না দিয়া থাকিতে পারে না ,— সে জানে তন্নষ্টং যন্ন দীয়তে । সর্বত্র এবং সকল কালেই মানুষ এই মধ্যস্থকে মানে! ইহারা ভাবলোকের ব্যাঙ্কের কর্তা — এরা নানা দিক হইতে নানা ডিপজিটের টাকা পায় — সে টাকা বদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য নহে ; সংসারে নানা কারবারে নানা লোক টাকা খাটাইতে চায় , তাহাদের নিজের মূলধন যথেষ্ট নাই — এই ব্যাঙ্কার নহিলে তাহাদের কাজ বন্ধ ।

 

এমনি করিয়া রূপের ভেদ প্রমাণে বাঁধা পড়িল , ভাবের বেগ লাবণ্যে সংযত হইল , ভাবের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য পটের উপর সুসম্পূর্ণ হইয়া ভিতরে বাহিরে পুরাপুরি মিল হইয়া গেল — এই তো সব চুকিল । ইহার পর আর বাকি রহিল কী ?

কিন্তু আমাদের শিল্পশাস্ত্রের বচন এখনও যে ফুরাইল না! স্বয়ং দ্রৌপদীকে সে ছাড়াইয়া গেল । পাঁচ পার হইয়া যে ছয়ে আসিয়া ঠেকিল সেটা বর্ণিকাভঙ্গং — রঙের ভঙ্গিমা ।

এইখানে বিষম খটকা লাগিল । আমার পাশে এক গুণী বসিয়া আছেন তাঁরই কাছ হইতে এই শ্লোকটি পাইয়াছি । তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম , রূপ , অর্থাৎ রেখার কারবার যেটা ষড়ঙ্গের গোড়াতেই আছে , আর এই রঙের ভঙ্গি যেটা তার সকলের শেষে স্থান পাইল চিত্রকলায় এ দুটোর প্রাধান্য তুলনায় কার কত ?

তিনি বলিলেন , বলা শক্ত ।

তাঁর পক্ষে শক্ত বৈকি ! দুটির পরেই যে তাঁর অন্তরের টান, এমন স্থলে নিরাসক্ত মনে বিচার করিতে বসা তাঁর দ্বারা চলিবে না। আমি অব্যবসায়ী , অতএব বাহির হইতে ঠাহর করিয়া দেখা আমার পক্ষে সহজ।

রঙ আর রেখা এই দুই লইয়াই পৃথিবীর সকল রূপ আমাদের চোখে পড়ে । ইহার মধ্যে রেখাটাতেই রূপের সীমা টানিয়ে দেয় । এই সীমার নির্দেশই ছবির প্রধান জিনিস । অনির্দিষ্টতা গানে আছে , গন্ধে আছে কিন্তু ছবিতে থাকিতে পারে না।

এইজন্যই কেবল রেখাপাতের দ্বারা ছবি হইতে পারে কিন্তু কেবল বর্ণপাতের দ্বারা ছবি হইতে পারে না । বর্ণটা রেখার আনুষঙ্গিক।

সাদার উপরে কালোর দাগ এই হইল ছবির গোড়া । আমরা সৃষ্টিতে যাহা চোখে দেখিতেছি তাহা অসীম আলোকের সাদার উপরকার সসীম দাগ । এই দাগটা আলোর বিরুদ্ধ তাই আলোর উপরে ফুটিয়া উঠে । আলোর উলটা কালো , আলোর বুকের উপরে ইহার বিহার ।

কালো আপনাকে আপনি দেখাইতে পারে না । স্বয়ং সে শুধু অন্ধকার , দোয়াতের কালির মতো । সাদার উপর যেই সে দাগ কাটে অমনি সেই মিলনে সে দেখা দেয় । সাদা আলোকের পটটি বৈচিত্র্যহীন ও স্থির , তার উপরে কালো রেখাটি বিচিত্রনৃত্যে ছন্দে ছন্দে ছবি হইয়া উঠিতেছে । শুভ্র ও নিস্তব্ধ অসীম রজতগিরিনিভ তারই বুকের উপর কালীর পদক্ষেপ চঞ্চল হইয়া সীমায় সীমায় রেখায় রেখায় ছবির পরে ছবির ছাপ মারিতেছে । কালীরেখার সেই নৃত্যের ছন্দটি লইয়া চিত্রকলার রূপভেদাঃ প্রমাণানি । নৃত্যের বিচিত্র বিক্ষেপগুলি রূপের ভেদ , আর তার ছন্দের তালটিই প্রমাণ ।

আলো আর কালো অর্থাৎ আলো আর না-আলোর দ্বন্দ্ব খুবই একান্ত । রঙগুলি তারই মাঝখানে মধ্যস্থতা করে । ইহারা যেন বীণার আলাপের মীড় — এই মীড়ের দ্বারা সুর যেন সুরের অতীতকে পর্যায়ে পর্যায়ে ইশারায় দেখাইয়া দেয় — ভঙ্গিতে ভঙ্গিতে সুর আপনাকে অতিক্রম করিয়া চলে । তেমনি রঙের ভঙ্গি দিয়া রেখা আপনাকে অতিক্রম করে ; রেখা যেন অরেখার দিকে আপন ইশারা চালাইতে থাকে । রেখা জিনিসটা সুনির্দিষ্ট ,— আর রঙ জিনিসটা নির্দিষ্ট অনির্দিষ্টের সেতু , তাহা সাদা কালোর মাঝখানকার নানা টানের মীড় । সীমার বাঁধনে বাঁধা কালো রেখার তারটাকে সাদা যেন খুব তীব্র করিয়া আপনার দিকে টানিতেছে , কালো তাই কড়ি হইতে অতিকোমলের ভিতর দিয়া রঙে রঙে অসীমকে স্পর্শ করিয়া চলিয়াছে । তাই বলিতেছি রঙ জিনিসটা রেখা এবং অরেখার মাঝখানের সমস্ত ভঙ্গি । রেখা ও অরেখার মিলনে যে ছবির সৃষ্টি সেই ছবিতে এই মধ্যস্থের প্রয়োজন । অরেখ সাদার বুকের উপর যেখানে রেখা-কালীর নৃত্য সেখানে এই রঙগুলি যোগিনী । শাস্ত্রে ইহাদের নাম সকলের শেষে থাকিলেও ইহাদের কাজ নেহাত কম নয় ।

পূর্বেই বলিয়াছি সাদার উপর শুধু-রেখার ছবি হয় , কিন্তু সাদার উপর শুধু – রঙে ছবি হয় না । তার কারণ রঙ জিনিসটার মধ্যস্থ — দুই পক্ষের মাঝখানে ছাড়া কোনো স্বতন্ত্র জায়গায় তার অর্থই থাকে না ।

এই গেল বর্ণিকাভঙ্গ ।

এই ছবির ছয় অঙ্গের সঙ্গে কবিতার কিরূপ মিল আছে তাহা দেখাইলেই কথাটা বোঝা হয়তো সহজ হইবে ।

ছবির স্থূল উপাদান যেমন রেখা তেমনি কবিতার স্থূল উপাদান হইল বাণী । সৈন্যদলের চালের মতো সেই বাণীর চালে একটা ওজন একটা প্রমাণ আছে — তাহাই ছন্দ । এই বাণী ও বাণীর প্রমাণ বাহিরের অঙ্গ , ভিতরের অঙ্গ ভাব ও মাধুর্য ।

এই বাহিরের সঙ্গে ভিতরকে মিলাইতে হইবে । বাহিরের কথাগুলি ভিতরের ভাবের সদৃশ হওয়া চাই ; তাহা হইলেই সমস্তটায় মিলিয়া কবির কাব্য কবির কল্পনার সাদৃশ্য লাভ করিবে ।

বহিঃসাদৃশ্য , অর্থাৎ রূপের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য , অর্থাৎ যেটাকে দেখা যায় সেইটাকে ঠিকঠাক করিয়া বর্ণনা করা কবিতার প্রধান জিনিস নহে । তাহা কবিতার লক্ষ্য নহে উপলক্ষ মাত্র । এইজন্য বর্ণনামাত্রই যে-কবিতার পরিণাম , রসিকেরা তাঁহাকে উঁচুদরের কবিতা বলিয়া গণ্য করেন না । বাহিরকে ভিতরের করিয়া দেখা ও ভিতরকে বাহিরের রূপে ব্যক্ত করা ইহাই কবিতা এবং সমস্ত আর্টেরই লক্ষ্য ।

সৃষ্টিকর্তা একেবারেই আপন পরিপূর্ণতা হইতে সৃষ্টি করিতেছেন তাঁর আর-কোনো উপসর্গ নাই । কিন্তু বাহিরের সৃষ্টি মানুষের ভিতরের তারে ঘা দিয়া যখন একটা মানস – পদার্থকে জন্ম দেয় , যখন একটা রসের সুর বাজায় তখনই সে আর থাকিতে পারে না , বাহিরে সৃষ্ট হইবার কামনা করে । ইহাই মানুষের সকল সৃষ্টির গোড়ার কথা । এইজন্যই মানুষের সৃষ্টিতে ভিতর – বাহিরের ঘাত – প্রতিঘাত । এইজন্য মানুষের সৃষ্টিতে বাহিরের জগতের আধিপত্য আছে । কিন্তু একাধিপত্য যদি থাকে , যদি প্রকৃতির ধামা-ধরা হওয়াই কোনো আর্টিস্টের কাজ হয় তবে তার দ্বারা সৃষ্টিই হয় না । শরীর বাহিরের খাবার খায় বটে কিন্তু তাহাকে অবিকৃত বমন করিবে বলিয়া নয় । নিজের মধ্যে তাহার বিকার জন্মাইয়া তাহাকে নিজের করিয়া লইবে বলিয়া । তখন সেই খাদ্য এক দিকে রসরক্তরূপে বাহ্য আকার , আর-এক দিকে শক্তি স্বাস্থ্য সৌন্দর্যরূপে আন্তর আকার ধারণ করে । ইহাই শরীরের সৃষ্টিকার্য । মনের সৃষ্টিকার্যও এমনিতরো । তাহা বাহিরের বিশ্বকে বিকারের দ্বারা যখন আপনার করিয়া লয় তখন সেই মানস – পদার্থটা এক দিকে বাক্য রেখা সুর প্রভৃতি বাহ্য আকার , অন্য দিকে সৌন্দর্য শক্তি প্রভৃতি আন্তর আকার ধারণ করে । ইহাই মনের সৃষ্টি — যাহা দেখিলাম অবিকল তাহাই দেখানো সৃষ্টি নহে ।

তারপরে ছবিতে যেমন বর্ণিকাভঙ্গং কবিতায় তেমনি ব্যঞ্জনা ( suggestiveness ) । এই ব্যঞ্জনার দ্বারা কথা আপনারঅর্থকে পার হইয়া যায় । যাহা বলে তার চেয়ে বেশি বলে। এই ব্যঞ্জনা ব্যক্ত ও অব্যক্তর মাঝখানকার মীড়। কবির কাব্যে এই ব্যঞ্জনা বাণীর নির্দিষ্ট অর্থের দ্বারা নহে , বাণীর অনির্দিষ্ট ভঙ্গির দ্বারা , অর্থাৎ বাণীর রেখার দ্বারা নহে , তাহার রঙের দ্বারা সৃষ্ট হয়।

আসল কথা , সকল প্রকৃত আর্টেই একটা বাহিরের উপকরণ , আর একটা চিত্তের উপকরণ থাকা চাই — অর্থাৎ একটা রূপ , আর একটা ভাব। সেই উপকরণকে সংযমের দ্বারা বাঁধিয়া গড়িতে হয় ; বাহিরের বাঁধন প্রমাণ , ভিতরের বাঁধন লাবণ্য । তার পরে সেই ভিতর বাহিরের উপকরণকে মিলাইতে হইবে কিসের জন্য ? সাদৃশ্যের জন্য । কিসের সঙ্গে সাদৃশ্য ? না , ধ্যানরূপের সঙ্গে কল্পরূপের সঙ্গে সাদৃশ্য । বাহিরের রূপের সঙ্গে সাদৃশ্যই যদি মুখ্য লক্ষ্য হয় তবে ভাব ও লাবণ্য কেবল যে অনাবশ্যক হয় তাহা নহে , তাহা বিরুদ্ধ হইয়া দাঁড়ায় । এই সাদৃশ্যটিকে ব্যঞ্জনার রঙে রঙাইতে পারিলে সোনায় সোহাগা — কারণ তখন তাহা সাদৃশ্যের চেয়ে বড়ো হইয়া ওঠে — তখন তাহা কতটা যে বলিতেছে তাহা স্বয়ং রচয়িতাও জানে না — তখন সৃষ্টকর্তার সৃষ্টি তাহার সংকল্পকেও ছাড়াইয়া যায় ।

অতএব , দেখা যাইতেছে ছবির যে ছয় অঙ্গ , সমস্ত আর্টের অর্থাৎ আনন্দরূপেরই তাই ।

Leave a Reply

Shop
Sidebar
0 Wishlist
0 Cart