চারটি কবিতা : বের্টোল্ট ব্রেখট
সবুজ নামে গাছকে সকালের অভিবাদন
১
ওহে সবুজ, অপরাধ স্বীকার করছি।
গত রাতে ঝড়ের শব্দে ঘুমোতে পারিনি মোটেই
তাকিয়ে দেখি মাতাল জংলির মতো
দুলছে তোমার শরীর। খারাপ মন্তব্য করতে প্রায় বাধ্য হলুম।
২
আজ তোমার উলঙ্গ শাখায় দেখি ঝিলিক দিচ্ছে সূর্য
তখনও শেষ দু-এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ছে যেন।
কিন্তু এখন তুমি জানো তোমার যোগ্যতা।
জীবনের তিক্ততম লড়াই তোমায় লড়তে হয়েছে কাল
তোমার ওপর যে কাল শকুনের দৃষ্টি পড়েছিল।
এখন আমি জানি : অসম্ভব নমনীয়তার জোরেই শুধু
আজ সকালেও তুমি দাঁড়িয়ে আছ স্থির।
৩
তোমার সাফল্য দেখে আজ মনে হচ্ছে, হে সবুজ
হাজার বাড়িঘরের মধ্যে থেকেও গত রাতে
ঝড়ের মুখে পড়ার মতো এত লম্বা
হয়ে ওঠাটাও তা হলে নেহাত সামান্য ব্যাপার নয় ।
না-না, আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে আমি কিছুই বলছি না
তৈমুর শুনেছি, গোটা পৃথিবীটাকে জয় করার ফালতো ঝমেলা সয়েছিল।
আমি তাঁকে মোটেই বুঝি না :
আরে বাবা, দু-ঢোক কড়া মদ গিললেই তো ছাতামাথা এই পৃথিবীর কথা
দিব্যি ভুলে থাকা যায়।
না-না, আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে আমি কিছুই বলছি না,
শুধু
বলতে চাই যে এমন লোক আমি অনেক দেখেছি
সত্যিই যারা দেখার মতো, উল্লেখের যোগ্য,
তারা যে ভরপুর বেঁচে আছে শুধু এই জন্যই
তাদের রীতিমতো শ্রদ্ধা করা যায়।
তুলনায় মহৎ লোকেরা খামোকাই বড্ড বেশি ঘাম ঝরায়।
এ সবেই বেশ বোঝা যায়
নিতান্ত নিজের মতো হয়েই তারা খুশি নয়-
খানিক ধোঁয়া ছেড়ে,
দু-পাত্তর মদ খেয়ে, শুয়ে-বসে-গড়িয়ে তাদের সুখ নেই।
এমনকী মেয়েদের কোল ঘেঁষে বসে কিঞ্চিৎ ওম পাওয়ার পক্ষেও
তাদের হৃদয় বড্ড ছোট!
জানি, তোমরা সবাই চাও যে আমি চলে যাই
জানি, তোমরা সবাই চাও যে আমি চলে যাই
তোমাদের পক্ষে একটু বেশিই দেখে ফেলি আমি, ঢের বেশি খাই,
বুঝতে পারছি আমার মতো লোকের সঙ্গে চলার
রীতিনীতি তোমাদের জানা নেই।
কিন্তু মশাইরা, সহজে আমি যাচ্ছি না।
সাফ-সাফ বলছি সব্বাইকে
ভাগের মাংস সব দিয়ে দাও আমায়।
পায়ে-পায়ে তোমাদের অনুসরণ করেছি সর্বদা
আগেই জানিয়েছি যে চলে যেতে হবে কিন্তু তোমাদেরই
তোমাদের ভাষা আমি মিছিমিছি শিখিনি বাবা।
শেষ পর্যন্ত
সকলেই ব্যাপারটা বুঝল,
কিন্তু পরের দিন আর মাংস জুটল না কারও।
আর-একদিন অপেক্ষা করলাম আমি,
আর-একটা সুযোগ দিলাম
অন্তত নিজেদের ভুল যাতে বুঝতে পারো।
যখন আবার ফিরে আসব
আরও খর চাঁদের আলোয় বসুন্ধরা
ফিরে আসব ট্যাঙ্কের মাথায়
চড়ে, কথা বলব বন্দুকের আগায়
নিকেশ করে দেব তোমাদের, বুঝেছ হে
নিঃশেষে দেব মুছে।
যেখান দিয়ে আমার ট্যাঙ্ক চলবে
সেটাই তখন রাস্তা
যা আমার বন্দুক বলবে
সেটাই একমাত্র কথা।
ছেড়ে দিতে পারি
শুধু আমার ভাইকে,
তারও মুখে তখন মারব টেনে লাথি ।
শহরে যারা বাস করে তাদের জন্য জনৈক পাঠকের একটি কবিতা
স্টেশনেই বিদায় করে দাও বন্ধুদের
ভোরসকালেই জামার বোতাম এঁটে প্রবেশ করো শহরে
দেখো, একটা ঘর পাওয়া যায় কোথায়, কিন্তু তার
দরজায় কেউ কড়া নাড়লে
খুলো না, না-না, কক্ষনো খুলো না
বরং
লোপাট করে দাও সব চিহ্ন।
হামবুর্গ বা অন্য কোন শহরে যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়
তোমার বাবা-মা-র সঙ্গে
একেবারে অপরিচিতের মতো এড়িয়ে যাও, কেটে পড়ো স্রেফ মোড় ঘুরে
মোটেই চিনতে যেও না যেন
তাদেরই দেওয়া টুপিতে ঢেকে ফেলো মুখ
দেখিও না, না-না, কক্ষনো দেখিও না তোমার মুখ
বরং
লোপাট করে দাও সব চিহ্ন।
ওখানে রাখা মাংস খেয়ে ফেল সব। সংযমের দরকার নেই কোন।
বৃষ্টি পড়লে যে-কোন বাড়িতে ঢুকে পড়ো, যে-কোন চেয়ারে বোস
কিন্তু না, বেশিক্ষণ নয়, বেরনোর সময় ভুলো না তোমার টুপিটা
বলেছি না,
লোপাট করে দাও সব চিহ্ন।
যা-কিছু তুমি বলছ, কক্ষনো দু-বার বোল না
যদি দেখো, তোমার ভাবনায় আর মৌলিকতা নেই কোন,
ভুলে যাও তার কথা।
যে কোথাও সই করেনি, যার কোন ছবি নেই,
যে কোত্থাও ছিল না কোনদিন, যে বলেনি কিছুই
তার হদিশ তারা পাবে কী ভাবে ?
দেখেশুনে, লোপাট করে দাও সব চিহ্ন।
যখন তোমার মৃত্যু নিয়েও ভাববে তখন
দেখো, সেখানে যেন কোন সমাধিফলক না-গজিয়ে ওঠে হঠাৎ
যেখানে শুয়ে আছ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে
তোমায় যেন অভিযুক্ত না-করে ফলকের উৎকীর্ণ হরফ।
আরও একবার বলি :
পারো তো লোপাট করে দাও সব চিহ্ন।
( এ সমস্তই আমায় শিখিয়েছে কিন্তু তারা !)
অনুবাদ : সন্দীপন ভট্টাচার্য
(এখানে প্রকাশিত লেখাপত্র শুধুই পড়ার জন্য। দয়া করে এর কোন অংশ কোথাও পুনর্মুদ্রণ করবেন না। ইচ্ছে করলে লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু অনুরোধ, গোটা লেখাটি কখনওই অন্য কোন ওয়েবসাইটে বা কোন সোশ্যাল নেটওয়রকিং সাইটে শেয়ার করবেন না। ধন্যবাদ।)